ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার সময় বাড়ানোর দাবি ব্যবসায়ীদের

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:২৯ পিএম

ছবি : সংগৃহীত
ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার মাসব্যাপী চলমান ২৯তম আসরের শেষ সপ্তাহে ছাড়ের ছড়াছড়ি চলছে। সরকারী ছুটির দিন শুক্রবার সকাল থেকেই ক্রেতা দর্শনার্থীদের ভিড় বেড়ে যায়। এবার মেলায় ইউরোপীয় স্টাইলে কেওয়াই টু টোনের আস্ত বাড়ি এবং কয়েদীদের তৈরি কারাপণ্যের প্যাভিলিয়নে দর্শনার্থীদের আগ্রহ দেখা গেছে। তবে বরাবরের মতোই পণ্যের দাম ও মান নিয়ে কিছু অভিযোগ রয়েছে।
শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় রাজধানী ঢাকা যাত্রাবাড়ি থেকে পরিবার নিয়ে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় এসেছিলেন চাকরিজীবী সুবর্ণা আক্তার। মেলায় আসতে যানজটের কারণে তাকে ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হতে হয়। কাঞ্চন ব্রিজের পূর্ব পার থেকে মেলা পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার রাস্তা তাদের হাঁটতে হয়েছে। এতে তার ৫ বছরের শিশু মেলায় প্রবেশ করেই খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়ে। শুধু সুবর্ণা আক্তার নয়, শুক্রবার ২৪ তম দিনে পূর্বাচলে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় আসতে দর্শনার্থীদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। এদিন মেলায় দর্শনার্থীর সমাগম বেশি হওয়ায় মেলার চারপাশের রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে দর্শনার্থীদের দূর-দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে মেলায় যেতে হয়।
মেলা ঘুরে দেখা যায়, পূর্বাচলের স্থায়ী প্যাভিলিয়নের ৪র্থ আসরের শেষ সপ্তাহে উপচে পড়া ভিড়। স্টলে স্টলে নানা পণ্যে ছাড়ের ঘোষণায় বেচাকেনা আগের চেয়ে বেড়েছে। কথা হয় মেলায় অবস্থান করা মিনিস্টার ইলেকট্রনিক্স প্যাভিলিয়নের বিক্রয়প্রতিনিধিদের সাথে। তারা জানান, তাদের পণ্যে ৩০% ছাড়সহ লাখপতি এমনকি কোটিপতি অফার বেশ সাড়া ফেলেছে। কোম্পানির ম্যানেজার হাবিবউল্লাহ বলেন, মেলায় প্রদর্শনীকে প্রাধান্য দিলেও বিক্রি বেড়েছে আগের তুলনায় বেশি। এ বছর লাখপতি থেকে কোটিপতি অফার লুফে নিচ্ছেন গ্রাহকরা। ফলে ভালো সাড়া পেয়েছি। মিনিস্টারের অধীনে ইলেকট্রনিক পণ্যের পাশাপাশি গৃহস্থালি পণ্যের বিক্রি আশানুরূপ হচ্ছে।
এদিকে, মাত্র ১৪ লাখে ইউরোপীয় আস্ত বাড়ি নিয়ে এসেছে কেওয়াই টু টোন। বাড়িটি দেখতে দর্শনার্থীদের ভিড় থাকলেও তেমন বুকিং নেই। পাশাপাশি জেলখানায় কয়েদীদের তৈরি পণ্য ক্রয়ে ক্রেতাদের আগ্রহ দেখা গেছে। বাড়ির বিক্রয়কর্মী আফরিন বলেন, গতবছর এই বাড়িটিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর আমাদের কোম্পানিতে সরাসরি বুকিং ভালো হয়েছে। তবে মেলা থেকে বুকিং কম থাকলেও উৎসুক লোকজন ছবি তুলছেন এবং ঘুরে দেখছেন, এতে আমরা তৃপ্ত।
এছাড়া শীত কমে যাওয়ায় শীতের পোশাক আর ব্লেজারের দোকানে ক্রেতার ভাটা পড়েছে। তারা ছাড় দিয়েও ক্রেতা পাচ্ছেন না বলে হতাশা প্রকাশ করেছেন। ব্লেজার বিক্রেতা নোমান বলেন, মেলায় এসে পুরোপুরি হতাশ হলাম। ৫০% ছাড় দিয়েও ক্রেতা পাচ্ছি না। এটি খুবই দুঃখজনক। হয়তো শীত কমে যাওয়ায় বিক্রিতে প্রভাব পড়েছে।
মেলায় কারাপণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রি সমানতালে চলছে। কথা হয় নারায়ণগঞ্জ ডেপুটি জেলার নাসির উদ্দীনের সঙ্গে। তিনি বলেন, কয়েদীরা তাদের তৈরি পণ্যের ৫০ ভাগ লভ্যাংশ পান। আর বৃহত্তর প্রদর্শনী হিসেবে আমরা বাণিজ্যমেলার অপেক্ষায় থাকি। এখান থেকে এই পণ্যগুলোর প্রচার ও বিক্রি হয়ে থাকে।
মেলা ঘুরে দেখা যায়, প্রায় সব পণ্যে ছাড় চলছে। তবে দাম ও মান নিয়ে কিছু অভিযোগ থাকলেও সংশ্লিষ্টরা মনে করেন কিছু ত্রুটি সংশোধন করলে মেলার আয়োজন আরও সফল হবে।
১৯৯৫ সাল থেকে বাণিজ্য মেলার আসর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বসলে গত ৪ বছর ধরে এ আসর পূর্বাচলে হচ্ছে। পূর্বাচলের আসরে যত দিন যায়, তত বাড়ে দর্শনার্থীদের ভিড়। ভিড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে মানুষের ভোগান্তিও। রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে মেলায় আসতে সময় লেগে যায় ৪-৫ ঘণ্টা। এর অন্যতম কারণ এশিয়ান বাইপাস, গাজীপুর বাইপাস এবং তিনশ ফুট সড়কের দীর্ঘ যানজট। এ কারণে মেলায় দর্শনার্থীদের পাশাপাশি ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরাও। এছাড়া রাস্তা দখল করে অবৈধ পার্কিং ও ফুটপাতের দোকানের কারণে যানজট আরও বাড়ে। মেলায় যাওয়া-আসায় তিন থেকে চারগুণ ভাড়া তো আছেই। এত ভোগান্তি সত্ত্বেও মেলায় আসছেন দর্শনার্থীরা।
শুক্রবার মেলার চতুর্থ ছুটির দিন হওয়ায় দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। মেলা শেষের দিকে হওয়ায় ক্রেতাদের ভিড়ও বেড়েছে স্টলগুলোতে। এতে ব্যবসায়ী ও বিক্রয়কর্মীদের যেন দম ফেলার ফুরসত নেই।
জানা গেছে, ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় ভোগান্তি ও বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না। যানজটসহ নানা ভোগান্তি পেরিয়ে মেলায় এসে দর্শনার্থীরা নিম্নমানের পণ্য দেখে হতাশ হয়ে ফিরছেন। শুক্রবার মেলার ২৪ তম দিনে দর্শনার্থীদের পদচারণায় কানায় কানায় পরিপূর্ণ ছিল পুরো মেলা প্রাঙ্গণ। মেলা শেষের দিকে হওয়ায় ক্রেতাদের আগমনও বেড়েছে। স্টলগুলোতে উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। ব্যাপক পরিমাণ দর্শনার্থী হওয়ায় মেলায় তৈরি হয়েছে ক্রেতা-ব্যবসায়ীদের মেলবন্ধন।
ছুটির দিন হওয়ায় এশিয়ান বাইপাস, গাজীপুর বাইপাস ও তিনশ ফুট সড়কে দীর্ঘ যানজট দেখা গেছে। এতে মেলার চারপাশের রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এদিন মেলার পরিবেশ ছিল পূর্ণমাত্রায় জীবন্ত। মেলা জাঁকজমকপূর্ণ হওয়ায় দর্শনার্থীরা খুশি। তবে মেলার শুরু থেকেই বিতর্ক পিছু ছাড়েনি। বাণিজ্য মেলা মানেই পুরো মেলা প্রাঙ্গণ ভরপুর থাকবে, স্টলগুলোর সামনে থাকবে ক্রেতাদের ভিড়, চারদিকে থাকবে উৎসবের আমেজ। ছুটির দিনে মেলা সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সকাল থেকে দর্শনার্থীরা আসতে শুরু করেন।
সকালে দর্শনার্থী কিছুটা কম থাকলেও বিকেলে পুরো মেলা মুখরিত হয়ে ওঠে। ছুটির দিন হওয়ায় ব্যবসায়ীরাও স্টলগুলোকে নানা রঙের বাতি দিয়ে সাজিয়ে তুলেছেন। মেলা সেজেছে অপরূপ রূপে। ছুটির দিন হওয়ায় মেলার ভেতরে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়েছে। সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় নাচ-গানসহ নানা আয়োজন ছিল। গৃহস্থালি, ইলেকট্রনিক্স, প্রসাধনী, কাশ্মীরি স্টলগুলোতে সবচেয়ে বেশি ভিড় দেখা গেছে।
শিশু পার্ক ও রেস্তোরাগুলোতে বসার কোনো জায়গা ছিল না। শিশু পার্কে দাঁড়ানোরও কোনো জায়গা ছিল না। রাইডগুলোর টিকিট কাটতে দর্শনার্থীদের দীর্ঘ লাইন ছিল। বেশি লোকের সমাগম হওয়ায় রেস্তোরাগুলো খাবারের দাম বেশি নিচ্ছিল। এতে দর্শনার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ভোগান্তিতে পড়েন।
এদিকে হাইওয়ে পুলিশ যানজট নিরসনের চেষ্টা করলেও লোকসমাগম বেশি হওয়ায় তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। যানজটে আটকে থাকে শত শত যানবাহন।
কসমেটিক্স ব্যবসায়ী জিতু ভূঁইয়া বলেন, মেলায় এত লোকের সমাগম আগে দেখিনি। মেলা শেষের দিকে হওয়ায় পণ্যে অনেক ছাড় দিচ্ছি। ছাড় পেয়ে ক্রেতারাও পণ্য কিনছেন।
থ্রি-পিস ব্যবসায়ী সাইদুর রহমান বলেন, মেলায় এত লোকের সমাগম দেখে আমরা ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি ফুটেছে। মেলায় বিক্রি ভালো হচ্ছে। বিক্রি বেশি হলে লোকসান হবে না আশা করি। ক্রেতা আকর্ষণে বিভিন্ন ছাড় দিচ্ছি। ছাড় পেয়ে ক্রেতারাও নিজেদের পছন্দের পণ্য কিনছেন।
রাজধানীর ঢাকার যাত্রাবাড়ি থেকে খোকন মিয়া স্ত্রীকে বানিজ্য মেলায় বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি বলেন, আমি সরকারি একটি ব্যাংকে চাকরি করি। আজ শুক্রবার ছুটির দিন তাই স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে মেলা এসেছি। মেলায় অনেক ভিড়। কোথাও পা ফেলার জায়গা নেই। ভিড়ের কারণে মেলার চারপাশের রাস্তায় অনেক যানজট। যানজটের কারণে ২ কিলোমিটার রাস্তা হেটে মেলায় এসেছি।
মহিবুর রহমান নামে এক দর্শনার্থীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, মেলায় অনেক লোকের সমাগম হয়েছে এবং উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। মেলার সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়েছে এবং গান শুনে ভালো লেগেছে। তবে আসার সময় যে যানজট দেখলাম তা কতক্ষণে শেষ হবে তা বলা যাচ্ছে না।
সুমনা নামে আরেক দর্শনার্থীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, বাণিজ্য মেলায় আসতে দুপুর ২টার দিকে যাত্রাবাড়ি থেকে রওনা হই এবং মেলায় পৌঁছেছি সন্ধ্যা ৭টার দিকে। দীর্ঘ যানজটের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছি। মেলা থেকে ফিরতেও একই ভোগান্তিতে পড়তে হবে। তবে বাণিজ্য মেলা এবার অনেক জমে উঠেছে।
যানজটে আটকে থাকা পিকআপ চালক রাসেল বলেন, '৩ ঘণ্টা ধরে মেলার সামনে জ্যামে বসে আছি। মাল নিয়ে টঙ্গী যাব। এই জ্যাম কখন শেষ হবে, কখন যাব তা জানি না। আগে জানলে মেলার সামনে দিয়ে না গিয়ে অন্য দিক দিয়ে যেতাম।'
অটোরিকশা চালক আব্বাস বলেন, 'কাঞ্চন ব্রিজ ও তিনশ ফুট সড়ক পুরোটা যানজটে আটকে আছে। গাড়ি একটুও নড়ছে না। যানজটের কারণে দর্শনার্থীরা হেঁটে মেলায় যাচ্ছে। এই যানজট কখন শেষ হবে কেউ বলতে পারছে না।'
গেইট ইজারাদার প্রতিষ্ঠান ডিজি ইনফোটেক লিমিটেডের ইনচার্জ আমিনুল ইসলাম বলেন, 'শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় মেলায় প্রচুর লোকের সমাগম হয়েছে। আমরা মেলায় আসা দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে এ বছর ই-টিকেটিংয়ের ব্যবস্থা রেখেছি, যাতে দর্শনার্থীরা নির্বিঘ্নে মেলায় প্রবেশ করতে পারে। তবে অতিরিক্ত লোকের সমাগম হওয়ায় ম্যানুয়ালিও দর্শনার্থীদের মেলায় প্রবেশ করানো হচ্ছে।'
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সচিব ও বাণিজ্য মেলা পরিচালক বিবেক সরকার বলেন, 'শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় মেলা কানায় কানায় পরিপূর্ণ ছিল। মেলায় দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা দিতে বিপুল পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন রাখা হয়েছে। মেলায় আসা-যাওয়ার জন্য ২০০টির বেশি বিআরটিসির শাটল বাস রাখা হয়েছে। দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশি হলে বাসের সংখ্যাও বাড়ানো হয়।'