Logo
Logo
×

জাতীয়

ওসমান পরিবারের ক্ষমতার অপব্যবহার, বিটিআরসির পাওনা ১২৬ কোটি টাকা নিয়ে জালিয়াতি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৯ পিএম

ওসমান পরিবারের ক্ষমতার অপব্যবহার, বিটিআরসির পাওনা ১২৬ কোটি টাকা নিয়ে জালিয়াতি

ওসমান পরিবারের ক্ষমতার অপব্যবহার, বিটিআরসির পাওনা ১২৬ কোটি টাকা নিয়ে জালিয়াতি

ফকিরাপুলের ডিআইটি রোডের একটি ছোট কক্ষে সাখাওয়াত হোসেনের ট্রাভেল এজেন্সির কার্যালয়। আসবাব বলতে শুধু একটি টেবিল ও তিনটি চেয়ার। ভাড়া ছয় হাজার টাকা। সাখাওয়াত ফকিরাপুলেই একটি মেসে থাকেন। তবে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) নথিপত্রে সাখাওয়াত কে টেলিকম নামের (পরে ইন্টারন্যাশনাল ভয়েস টেল লিমিটেড নামকরণ হয়) একটি ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে বা আইজিডব্লিউ কোম্পানির অংশীদার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)।

আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশ থেকে টেলিফোন কল বাংলাদেশে আসে। কে টেলিকমের কাছে বিটিআরসির পাওনা ১২৬ কোটি টাকার বেশি। পাওনা আদায়ে বিটিআরসি কোম্পানিটির মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

প্রশ্ন হলো, সাখাওয়াত কীভাবে এত বড় প্রতিষ্ঠানের মালিক হলেন? গত ১৭ ডিসেম্বর ফকিরাপুলে সাখাওয়াতের কার্যালয়ে গিয়ে তাঁর কাছে এই প্রশ্নই করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেই তো জানতাম না, আমি মালিক। গত ১৮ অক্টোবর বিটিআরসির কর্মকর্তারা রাঙ্গুনিয়া (চট্টগ্রাম) থানার পুলিশ নিয়ে আমার গ্রামের বাড়িতে যান। তখনই আমি এই কোম্পানি ও নিজের মালিকানার কথা জানতে পারি।’

কে টেলিকমের মালিক ছিল নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের পরিবার। শামীম ওসমানের স্ত্রী সালমা ওসমান ও ছেলে ইমতিনান ওসমানের নামে ২০১২ সালে ১৫ বছরের জন্য কে টেলিকমের লাইসেন্স নেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটিতে শামীম ওসমানের শ্যালক তানভীর আহমেদ এবং তাঁর (শামীম ওসমান) ঘনিষ্ঠ জয়নাল আবেদীন মোল্লা ও জাহাঙ্গীর হোসেন মোল্লার মালিকানাও ছিল।

নথিপত্রে দেখা যায়, ২০১৩ সালের ৪ আগস্ট ওসমান পরিবার কে টেলিকমের মালিকানা সাখাওয়াত হোসেন, সিলেটের স্কুলশিক্ষক দেবব্রত চৌধুরী ও বগুড়ার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী রাকিবুল ইসলামের নামে হস্তান্তর করে। তাঁরা তিনজন বলেছেন, তাঁরা কেউই এ বিষয়ে জানতেন না। জালিয়াতি করে তাদের মালিক দেখানো হয়েছে।

এদিকে বিটিআরসি ও সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সরকারের পাওনা টাকার দায় এড়াতে তড়িঘড়ি করে ওসমান পরিবার কে টেলিকমের মালিকানা ওই তিন ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করে। এ ক্ষেত্রে জালিয়াতি করা হয়েছে। ভুয়া ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা ওসমান পরিবারের এই কারসাজির সহযোগী ছিল।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শামীম ওসমান পরিবারসহ আত্মগোপনে রয়েছেন। তাঁর (শামীম ওসমান) বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও কোম্পানি আইনবিশেষজ্ঞ আহসানুল করিম বলেন, যাচাই করার দায়িত্ব ছিল বিটিআরসির। এ ঘটনায় মনে হচ্ছে, জেনেশুনেই এমন ব্যক্তিদের নামে মালিকানা হস্তান্তরের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যাঁরা ব্যবসাটা সম্পর্কে জানেন না, বরং ভুক্তভোগী।

বিটিআরসির বিপুল পাওনা

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেলিযোগাযোগ খাতে বেশ কিছু লাইসেন্স দেওয়া হয়। তখন বিদেশ থেকে কল আনা ছিল লাভজনক ব্যবসা। জাহাঙ্গীর কবির নানক, শামসুল হক টুকু, শামীম ওসমানসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা তখন আইজিডব্লিউ লাইসেন্স নেন। লাইসেন্স নিতে ফি দিতে হয় এবং বিদেশ থেকে আনা কল থেকে আয়ের একটি অংশ বিটিআরসিকে দিতে হয়। ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পাওয়া ব্যক্তিরা বিটিআরসির পাওনা না দিয়ে একপর্যায়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন। ছয়টি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিটিআরসি এখনো ৯২১ কোটি টাকার বেশি পাবে।

বিটিআরসি নথিপত্র অনুযায়ী, কে টেলিকমের কাছ থেকে পাওনা আদায়ে বিটিআরসি ২০১৪ সালের ২২ জুন মামলা করে। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে বিটিআরসি ও পুলিশ যায় নতুন ‘মালিকদের’ বাড়িতে।

শেয়ার হস্তান্তরের মাধ্যমে নতুন ‘মালিক’ হওয়া বগুড়া আদমদীঘির বাসিন্দা রাকিবুল ইসলাম বলেন, তিনি কীভাবে এই কোম্পানির মালিক হয়েছেন, তা তিনি জানেন না। তিনি ২০০৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ঢাকার সাভারে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেছেন। এখন বগুড়ায় একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে সামান্য বেতনে অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করেন।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এখানে বহুমাত্রিক দুর্নীতি হয়েছে। ওসমান পরিবার ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রকে বঞ্চিত করেছে। নিজেদের বাঁচাতে অন্যদের ওপর দায় চাপিয়েছে। অন্যের জাতীয় পরিচয়পত্র চুরি করে ভুয়া নথি তৈরি করা হয়েছে এবং জড়ানো হয়েছে নিরপরাধ ব্যক্তিদের। সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

২০২৪ সালের মে মাসে বিটিআরসি কর্মকর্তারা বগুড়ায় তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন উল্লেখ করে রাকিবুল বলেন, ‘বিটিআরসির স্যাররা দেখে গেছে আমি কী অবস্থায় থাকি।’ তিনি বলেন, তাঁর ধারণা তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ব্যবহার করে এই জালিয়াতি হয়েছে। শুধু এ ঘটনা নয়, তাঁর এনআইডি ব্যবহার করে মুঠোফোনে আর্থিক সেবার (এমএফএস) হিসাবও খোলা হয়েছিল।

সিলেটের গোলাপগঞ্জের সরকারি এমসি একাডেমির ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক দেবব্রত চৌধুরীর খোঁজ পেয়ে বিটিআরসি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁকে পুলিশ দিয়ে গ্রেপ্তার করায়। দেবব্রত বলেন, তাঁকে গ্রেপ্তারের খবরে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে এবং পরদিন তাঁকে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেয় পুলিশ। তিনি ২০০৩ সাল থেকে এমসি একাডেমিতে কর্মরত। সিলেট নগরে দুই কক্ষের একটি ভাড়া বাসায় স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন।

মালিকানা হস্তান্তর কীভাবে

কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিকানা হস্তান্তর হয় আরজেএসসি থেকে। আর টেলিযোগাযোগ খাতের লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের মালিকানা স্থানান্তরে বিটিআরসির কাছে আবেদন করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনুমোদন নিতে হয়।

কে টেলিকমের মালিকানা হস্তান্তরের আবেদন যাচাই করা হয়েছিল কি না, জানতে চাইলে বিটিআরসি কর্তৃপক্ষ লিখিত বক্তব্যে বলেছে, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এবং সরকারের সম্মতি নিয়ে মালিকানা হস্তান্তরের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে।

যদিও বিটিআরসির একটি সূত্র বলছে, কে টেলিকম আবেদনের সঙ্গে যেসব নথিপত্র দিয়েছিল, তা যাচাই ছাড়াই তড়িঘড়ি অনুমোদন দেওয়া হয়। যাচাই করলে ভুয়া ছবি দেওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ত। আইন অনুযায়ী, মালিকানার ক্ষেত্রে আর্থিক সংগতি আছে কি না, তা যাচাই করা বিটিআরসির দায়িত্ব।

অন্যদিকে আরজেএসসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তখন নিয়ম ছিল মালিকানা হস্তান্তরকারীর পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় নথিপত্রের সঙ্গে সবার স্বাক্ষরসহ সরকারের অনুমোদনপত্র জমা দিতে হবে। এই ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও কোম্পানি আইনবিশেষজ্ঞ আহসানুল করিম বলেন, যাচাই করার দায়িত্ব ছিল বিটিআরসির। এ ঘটনায় মনে হচ্ছে, জেনেশুনেই এমন ব্যক্তিদের নামে মালিকানা হস্তান্তরের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যাঁরা ব্যবসাটা সম্পর্কে জানেন না, বরং ভুক্তভোগী। তিনি বলেন, এটি রাজনৈতিক পরাক্রমশালী ব্যক্তিদের হীন স্বার্থের বলি হওয়ার একটি উদাহরণ।

বিটিআরসি ২০১৪ সালে যে মামলা করে, তার এজাহারে মালিকানা পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করা হয়নি। বরং মূল মালিকদের বাদ দিয়ে নতুন ‘মালিকদের’ পেছনেই ছুটেছে তারা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সবাই জানে কে টেলিকমের মালিক শামীম ওসমান ও তাঁর পরিবার। তারপরও নিরীহ তিন ব্যক্তির বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে হয়রানি করা হয়েছে।

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher
Email: [email protected]

অনুসরণ করুন