Logo
Logo
×

জাতীয়

ঢাকায় চার দিনে চালানো হয় সাড়ে ২৫ হাজার গুলি

Icon

যুগেরচিন্তা২৪ ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম

ঢাকায় চার দিনে চালানো হয় সাড়ে ২৫ হাজার গুলি

ছবি : সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে রাজধানীর সাতটি এলাকায় চার দিন ধরে ২৫ হাজারেরও বেশি গুলি ব্যবহার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত বছরের ১৮ জুলাই থেকে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির সময় যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, রামপুরা, উত্তরা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এই নির্বিচার গুলি চালানো হয়। থানায় দায়ের করা ২৮টি মামলার এজাহার বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া যায়।

এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ওই সময় আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের মোট ২৫ হাজার ৬৮৩ রাউন্ড গুলি নিক্ষেপ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭.৬২ বোরের গুলি ৩ হাজার ৯৪টি, যা চায়নিজ রাইফেল, এসএমজি ও পিস্তল থেকে ছোড়া হয়েছে। আগ্নেয়াস্ত্র বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই গুলি প্রাণঘাতী।

এছাড়া ১১ হাজার ৮৪৫টি সিসা কার্তুজ, শটগান থেকে ২ হাজার ২৯৭ রাউন্ড, পিস্তল থেকে ২৬৮ রাউন্ড এবং ৮ হাজার ৩৬ রাউন্ড রাবার বুলেট ছোড়া হয়। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে ১ হাজার ৮৫টি সাউন্ড গ্রেনেড ও ২ হাজার ৬৬০ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করা হয়। এছাড়া লাইট হ্যান্ড গ্রেনেড ও লিডবল কার্তুজও নিক্ষেপ করা হয়।

পুলিশের এক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, ৭.৬২ বোরের গুলি প্রাণঘাতী হলেও অন্যান্য গুলি প্রাণঘাতী নয়। তবে শটগানের সিসা কার্তুজ বা রাবার বুলেট খুব কাছ থেকে ছোড়া হলে প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে। এছাড়া লিডবল সাধারণত শটগান দিয়ে ছোড়া হয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আন্দোলন দমনে কত পরিমাণ গোলাবারুদ ব্যবহার করা হয়েছে তার তালিকা তৈরি হচ্ছে। এজন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সাধারণত সংঘাতের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে দায়ের করা মামলাগুলোর এজাহারে পুলিশের ভূমিকা উল্লেখ থাকে। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে পুলিশ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ঘটনায় এসব মামলা দায়ের করেছিল। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে মামলা নিষ্পত্তি করা হয়।

গত বছরের ১৮ জুলাই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ডাক দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তখন আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও মোহাম্মদপুর এলাকায় নির্বিচারে গুলিবৃষ্টি হয়। ১৮ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত চার দিনে সারা দেশে গুলিতে ১২৮ জন আন্দোলনকারী নিহত হন, এর মধ্যে ৭৭ জন রাজধানীতে এবং ১৯ জুলাই রাজধানীতে নিহত হন ৪৪ জন।

মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বৃষ্টির মতো গুলি করেছে। গত বছরের জুলাই মাসে আন্দোলনের সময় শাহবাগ থানায় দায়ের করা তিনটি মামলার এজাহারে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় পুলিশ ১৯৬টি সাউন্ড গ্রেনেড, ১১৮ রাউন্ড সিসা কার্তুজ, ২০২ রাউন্ড রাবার বুলেট, ৭৮টি লং শেল, ৮১টি শট শেল, ৪৩ রাউন্ড চায়নিজ রাইফেলের গুলি এবং ৯টি লাইট হ্যান্ড গ্রেনেড ব্যবহার করেছে।

মোহাম্মদপুর থানার সাতটি মামলায় দেখা যায়, চার দিনে ২১৯টি সাউন্ড গ্রেনেড, ২ হাজার ১৩৫ রাউন্ড সিসা কার্তুজ, ৯৩৮ রাউন্ড রাবার বুলেট, ২২৬টি লং শেল, ২৬টি শট শেল এবং ৮০০ রাউন্ড শটগানের গুলি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাণঘাতী ৭.৬২ রাইফেল থেকে ১১৮ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছে।

রামপুরা থানার এক মামলায় ৬টি সাউন্ড গ্রেনেড, ৩০৭ রাউন্ড শটগানের গুলি, ৪টি প্রজেক্টাইল, ১৮০ রাউন্ড রাবার বুলেট এবং ২৫০ রাউন্ড সিসা বুলেট ব্যবহার করা হয়েছে।

কদমতলী থানার একটি মামলায় ১ হাজার ১৭৫ রাউন্ড শটগানের গুলি, ১১০টি টিয়ার গ্যাসের শেল এবং ৭১৮ রাউন্ড চায়নিজ রাইফেলের গুলি নিক্ষেপ করা হয়েছে। ধানমন্ডি মডেল থানায় ১১৫ রাউন্ড শটগানের গুলি, ১০টি টিয়ার গ্যাসের শেল, ৫৮টি সাউন্ড গ্রেনেড এবং ৩৩৭ রাউন্ড চায়নিজ রাইফেল ও এসএমজি থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে। এছাড়া ২০ রাউন্ড রাবার বুলেট ব্যবহার করা হয়েছে।

যাত্রাবাড়ী থানার ছয়টি মামলায় ৯ এমএম পিস্তল থেকে ৫ রাউন্ড গুলি, পুলিশের পিস্তল থেকে ২৫৭ রাউন্ড, ৭.৬২ ও ৯.৯২ থেকে ৫ রাউন্ড গুলি, ৪ হাজার ৩৭৪ রাউন্ড রাবার বুলেট, ৭ হাজার ৬৪৮ রাউন্ড সিসা বুলেট, ৪৭৩টি সাউন্ড গ্রেনেড এবং ১ হাজার ১৮১টি গ্যাসের শেল ছোড়া হয়েছে। চায়নিজ রাইফেল থেকে ১ হাজার ২৩৮ রাউন্ড ৭.৬২ বুলেট এবং ১৫টি প্রজেক্টাইল ব্যবহার করা হয়েছে।

উত্তরা পূর্ব থানার পাঁচটি মামলার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসএমজি থেকে ৭.৬২ গুলি ছোড়া হয়েছে ১৭ রাউন্ড, লং ও শট শেল ১৪৯টি, চায়নিজ রাইফেল থেকে ৭.৬২ গুলি ৬টি, রাবার কার্তুজ ১ হাজার ৯৭৯টি এবং সাউন্ড গ্রেনেড ৬১টি। এছাড়া গ্যাসের শেল ৫৩৮টি ব্যবহার করা হয়েছে।

উত্তরা পশ্চিম থানার তিনটি মামলায় দেখা গেছে, সাউন্ড গ্রেনেড ৭২টি, গ্যাস শেল ৫০টি, রাবার বুলেট ৩৪৩টি, সিসা বুলেট ১৫ হাজার ১ রাউন্ড এবং চায়নিজ রাইফেল থেকে ৩৭৭ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছে।

প্রাণঘাতী ৭.৬২ গুলির ব্যবহার বেশি যাত্রাবাড়ী, ধানমন্ডি ও উত্তরায়। মামলাগুলোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় পুলিশ তুলনামূলক হালকা অস্ত্র ব্যবহার করেছে। গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট ও ছররা গুলি বেশি ছোড়া হয়েছে। তবে যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, ধানমন্ডি ও উত্তরা এলাকায় চায়নিজ রাইফেল, এসএমজি ও পিস্তল থেকে ৭.৬২ গুলি বেশি ব্যবহার হয়েছে। যাত্রাবাড়ীতে পিস্তল থেকে ২৫৭ রাউন্ড এবং চায়নিজ রাইফেল থেকে ১ হাজার ২৩৮ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। ৫২ জন উপপরিদর্শক (এসআই) তাদের নামে ইস্যু করা আগ্নেয়াস্ত্র থেকে এই গুলি ছোড়েন। যাত্রাবাড়ীর পাশের কদমতলীতে চায়নিজ রাইফেলের ৭১৮ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। উত্তরা পশ্চিম থানায় পুলিশের ১৫ জন সদস্য চায়নিজ রাইফেল থেকে ৩৭৭ রাউন্ড গুলি নিক্ষেপ করেন। শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চায়নিজ রাইফেল থেকে ৪৩ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। মোহাম্মদপুরে আন্দোলন দমাতে পুলিশ ১১৮ রাউন্ড ৭.৬২ বুলেট খরচ করে। ১০ জন পুলিশ সদস্য তাদের রাইফেল থেকে এসব গুলি ছোড়েন, যার মধ্যে চারজন ২০ রাউন্ড করে ছোড়েন। ধানমন্ডিতে চায়নিজ রাইফেল ও এসএমজি থেকে ৩৩৭ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়।

পুলিশ সূত্র জানায়, প্রাণঘাতী ৭.৬২ মিলিমিটারের গুলি রাইফেল বা এসএমজি থেকে ছোড়া হলে তা লং রেঞ্জ এবং পিস্তল থেকে ছোড়া হলে শট রেঞ্জ বলা হয়। অর্থাৎ রাইফেল, এসএমজি ও পিস্তল থেকে এই গুলি ব্যবহার করা হয়।

মামলাগুলোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২৮টি ঘটনায় পুলিশ ১ হাজার ৮৫টি সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়েছিল, যার মধ্যে ১৫ জন সদস্য ছুড়েছেন সাড়ে ৬০০ সাউন্ড গ্রেনেড। যাত্রাবাড়ী এলাকায় পাঁচজন কনস্টেবল ৫০টি করে, একজন ৪৫টি এবং অন্য এক কনস্টেবল ২০টি সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এক এসআই এক ঘটনাতেই ৬০টি সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। আরেক এসআই ৩৯টি এবং অন্য দুই এসআই ৩৮টি ও ৩৫টি করে সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়েন। ধানমন্ডি এলাকায় একজন এসআই ছুড়েন ৩০টি সাউন্ড গ্রেনেড।

যা বললেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

আন্দোলন চলাকালে কনস্টেবল থেকে ডিসি পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি গুলি করার অভিযোগ উঠেছে। ৫ আগস্টের পর অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে পদায়ন ও পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে বলে পুলিশে অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, তদন্তের পর যাদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের ধরা হচ্ছে।


তথ্যসুত্র : কালবেলা


Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher
Email: [email protected]

অনুসরণ করুন