বন খেয়ে স্ত্রীকে নিয়ে কানাডায় মোশাররফ
সাবেক বনসংরক্ষক মোশাররফ হোসেন তার স্ত্রী পারভীন সুলতানা ওরফে মেঘনাকে নিয়ে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন বলে তার ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র জানিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ১১২ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জণের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাক অনুসন্ধানে মোশাররফ তার স্ত্রী পারভীন সুলতানা ওরফে মেঘনাসহ পরিবারের সদস্যদের বিপুল সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। মোশাররফ বর্তমানে মেঘনা রিয়েল এস্টেট লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। ২০০৫ সালের জুন মাসে চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় ‘বাধ্যতামূলক অবসর’-এ পাঠানো হয় তাকে। চাকরিতে থাকাকালে তিনি নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বলে অভিযোগে বলা হয়। নামে-বেনামে মোশাররফ-মেঘনা দম্পতির রয়েছে বিপুল পরিমান সম্পদ। তাদের আছে মেঘনা, জুয়েলার্স, মেঘনা রিসোর্ট, মেঘনা ফিটনেস সেন্টার ও মেঘনা রিয়েল স্টেট ব্যবসাসহ বহু ব্যবসা। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বেশির ভাগ সম্পদই করেছেন তিনি স্ত্রী মেঘনার নামে। এর আগে ২০০৭ সালে তার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ জমা হলেও তিনি সেই অভিযোগ ধামা চাপা দেন। দুদকে জমা হওয়া লিখিত অভিযোগ থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, ‘সাবেক বন সংরক্ষক মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজে ও স্ত্রী পারভীন সুলতানা মেঘনার নামে অবৈধ সম্পদ অর্জণের অভিযোগ কমিশনে চলমান রয়েছে।’ অপর একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের বিরুদ্ধে একটি অনুসন্ধান টিম গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
দুদকে জমা হওয়া অভিযোগের তথ্য মতে, মোশাররফের নামে আছে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ১৬ নম্বর সড়কে জেনেটিক প্লাজায় ৩ হাজার বর্গফুটের বাণিজ্যিক স্পেস, যার আনুমানিক দাম ৬ কোটি টাকা, ঢাকার চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটে ২ কোটি টাকা মূল্যের ৩০০ বর্গফুটের দোকান, ঢাকার পূর্বাচলে ২০ কোটি টাকা মূল্যের স্থাপনাসহ ১০ কাঠা জমি, বাগেরহাটের গোপালকাঠি গ্রামে ২০ কোটি টাকা মূল্যের স্থাপনাসহ ১০ কাঠা জমি। এ ছাড়া বিভিন্ন জনকে ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে ১ কোটি টাকা। মোশাররফের মেয়ে মোহনা থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে ৫ কোটি টাকায় তার নামে কেনা হয়েছে একটি ফ্ল্যাট।
অভিযোগে আরও বলা হয়, ‘মোশাররফের স্ত্রী পারভীন সুলতানার মেঘনার নামে ধানমন্ডির ১১ নম্বর রোডে অজান্তা অ্যাপার্টমেন্টে ৪ কোটি টাকা মূল্যের ২ হাজার ৪০০ বর্গফুটের ফ্লাট, ঢাকার মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে মেমোরো ভিলায় ৫ কোটি টাকা মূল্যের ৪ হাজার ৮২০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিং সোসাইটির বি ব্লকে ৯ কাঠা জমিতে ১০ কোটি টাকা মূল্যের বহুতল বাড়ি, মানিকগঞ্জের রাথোরা মৌজায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের ২০ বিঘা জমি, ঢাকার বাড্ডার সাঁতারকুল মৌজায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের ৮ বিঘা জমি, রাজধানীর পান্থপথে বসুন্ধরা সিটির লেভেল-১, ব্লক সিতে ৪ কোটি টাকা মূল্যের ৪০০ বর্গফুটের দোকান, রাজধানীর ৫৩, বায়তুল মোকাররমে ১০ কোটি টাকার ৩০০ বর্গফুটের মেঘনা জুয়েলার্স নামে দোকান, কক্সবাজারের টেকনাফে ৫ কোটি টাকা মূল্যের স্থাপনাসহ ৩ বিঘা জমি, কক্সবাজার ইনানী সমুদ্রসৈকতে ১০ কোটি টাকা মূল্যের স্থাপনাসহ ১ বিঘা জমি ও চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে ১০ কোটি টাকা মূল্যের ৬ কাঠা জমি, চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের ৬ কাঠা জমি। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআরসহ বিপুল সম্পদ রয়েছে মোশাররফ ও তার পরিবারের সদস্যদের। স্ত্রী মেঘনার নামে চালু করেছেন মেঘনা’স ফিটনেস সেন্টার।
মোশাররফ হোসেন ও তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন মো. রিয়াজ উদ্দিন নামে এক ব্যাক্তি। তিনি দৈনিক মানবাধিকার খবর পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। একসময় মেঘনা রিয়েল স্টেটের অংশীর ছিলেন। মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ঢাকার মুখ্যমহানগর হাকিম আদালতে একটি প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের মামলা করেন রিয়াজ। মামলাটির তদন্ত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
আইনজীবী আবু সাঈদ মোল্লা পাওনা টাকা আদায়ের জন্য মোশাররফকে একটি নোটিশ দেন। তাতে উল্লেখ করেন, ‘আপনি বাংলাদেশ সরকারের সাবেক বন সংরক্ষক। আপনার পক্ষে আমি ঢাকার মূখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে, জজ কোর্ট মোশাররফ হোসেন বনাম ফারহানা ইসলাম পরিবেশ আদালতে মামলাসহ ও মহামান্য হাইকোর্টে মামলা পরিচালনা করি। আপনার পক্ষে আপনার ব্যবসায়িক অংশীদার রিয়াজউদ্দিন শুরু থেকেই যোগাযোগ রক্ষা করেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, রিয়াজ উদ্দিন প্রায় দুই বছরের অধিক কাল যাবত আমার সাথে যোগাযোগ করছেন না। বিষয়টি আপনাকে ফোনে ও মৌখিকভাবে কয়েকবার জানানো হলেও, আপনি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। মামলাগুলো বর্তমানে চলমান আছে এবং আমি নিয়মিত পদক্ষেপও গ্রহন করছি। আপনার নিকট বিপুল অংকের অর্থ পাওনা আছি। পাওনা পরিশোধ করার জন্য অনুরোধ করছি।’
ভুক্তভোগী রিয়াজ উদ্দিন জানান, মোশাররফ হোসেনের এক ছেলে পুলিশ কর্মকর্তা এবং তার তার বড় ভাইয়ের মেয়ের জামাতা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে রিয়াজ উদ্দিনের বাসায় পুলিশ পাঠিয়ে দফায় দফায় হয়রানী করেন।
দেশে জরুরী অবস্থা জারির পর তৎকালীন প্রধান বন সংরক্ষক ওসমানগনি গ্রেপ্তার হয় এবং তার কাছ থেকে বিপুল টাকা উদ্ধার হয়। ওই সময় ওসমান গনির প্রধান সহযোগী মোশাররফ হোসেন অন-এরাইভাল ভিসায় প্রথমে মালয়েশিয়া, পরে সিংগাপুর, কম্বোডিয়া, লাওস, মরিশাস ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আত্মগোপন করেন থাকেন। ২০০৫ সালে চাকরি হতে অব্যাহতি পাওয়ার পর ঢাকা সিটি কর্পোরেশন থেকে মেঘনা বিল্ডার্স নামে ট্রেড লাইসেন্সের মাধ্যমে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শুরু করে। রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শুরুর মূল উদ্দেশ্য ছিল তার অবৈধ টাকা বৈধ করা। তার দূর্নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে সে মেঘনা রিয়েল স্টেট ও মেঘনা বিল্ডার্সে পার্টনারশীপ দেওয়ার নাম করে অনেকের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেছে। তার প্রতারণা ও বিভিন্ন জনকে হুমকির অভিযোগে বেশ কয়েকটি জিডি ও মামলা রয়েছে। আদালত থেকে তার বিরুদ্ধে একাধিক পরোয়ানা থাকায় তিনি আত্মগোপনে আছেন। একটি সূত্র জানিয়েছে তিনি ইতোমধ্যে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি বর্তমানে স্বস্ত্রীক কানাডায় মেয়ের কাছে অবস্থান করছেন।
এবিষয়ে বনখেকো মোশাররফ ও তার স্ত্রীর জানার জন্য তাদের দুটি নম্বরে ফোন করলে বন্ধ পাওয়া যায়। হোয়াসটঅ্যাপে মেসেজ দেওয়া হলে মোশাররফ হোসেন মেসেজ দেখন কিন্তু তিনি কোন জবাব দেননি।