রোজার আগে বাজার থেকে উধাও বোতলজাত সয়াবিন তেল

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৪৬ পিএম

ছবি : সংগৃহীত
রোজার একদিন আগে বাজার থেকে বোতলজাত সয়াবিন তেল উধাও হয়ে গেছে। পাঁচটি বাজার ঘুরেও এক লিটারের বোতল পাওয়া যাচ্ছে না। পাড়া-মহল্লার মুদি দোকানগুলোও খালি। ক্রেতারা শঙ্কা প্রকাশ করছেন যে রমজানে বড় সংকট হতে পারে।
তবে দেশে ভোজ্যতেলের কোনো সংকট নেই। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এবার এক লাখ টনের বেশি আমদানি হয়েছে। পাইপলাইনে আছে আরও ৮ লাখ টনের বেশি, যা দেশে ঢোকার অপেক্ষায়। তারপরও বোতলজাত সয়াবিন তেল বাজার থেকে উধাও। এর কারণ হলো সিন্ডিকেট। জনগণের প্রশ্ন, এই সিন্ডিকেট ভাঙবে কবে?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারিভাবে ফের দাম বাড়াতে দেশের ৬-৭টি কোম্পানি ভোক্তাকে জিম্মি করে রেখেছে। সরবরাহ কমিয়ে তেলশূন্য করা হয়েছে বাজার। কর্তৃপক্ষের কাছে প্রমাণ থাকলেও অদৃশ্য শক্তির কাছে তারা বারবার মাথা নত করছে। ফলে বাজারে অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন ভোক্তা।
রমজান সামনে রেখে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন ভোজ্যতেলের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছে। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে রমজানে চাহিদা ৩ লাখ টন। দেশে গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি আমদানি হয়েছে ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫৪৮ টন। দেশে উৎপাদন করা হয় ২ লাখ ৫০ হাজার টন। আমদানি পর্যায়ে এখনো পাইপলাইনে আছে ৮ লাখ ১২ হাজার ৫৬৫ টন। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য নিম্নমুখী।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি দেশে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খালাস হয়েছিল ২১ লাখ ৭০ হাজার ৩ টন। এর মধ্যে ৫ লাখ ২১ হাজার ৯৫২ টন সয়াবিন এবং ১৬ লাখ ৪৮ হাজার ৫১ টন পাম অয়েল। চলতি অর্থবছর (২০২৪-২৫) একই সময়ে ভোজ্যতেল খালাস হয়েছে ২২ লাখ ৭০ হাজার ২৮৯ টন। এর মধ্যে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ৩৮৬ টন পাম অয়েল এবং ৮ লাখ ৩৩ হাজার ৯০৩ টন সয়াবিন তেল। আগের তুলনায় এক লাখ টনের বেশি তেল বেশি আমদানি হয়েছে। তারপরও বাজারে নেই ভোজ্যতেল।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর জিনজিরা কাঁচাবাজারের ৭টি দোকান ঘুরেও বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যায়নি। নয়াবাজারের ৬টি মুদি দোকানেও একই অবস্থা। কাওরান বাজারের ৫টি মুদি দোকানের মধ্যে একটি দোকানে এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া গেলেও বোতলের গায়ে মূল্য লেখা নেই। বিক্রেতারা মুছে লিটার ১৯৫ টাকা চাইছেন, যার সরকার নির্ধারিত মূল্য ১৭৫ টাকা। তবে খোলা সয়াবিন তেল লিটার ২০০-২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যার সরকার নির্ধারিত মূল্য ১৫৭ টাকা।
নয়াবাজারে সয়াবিন তেল কিনতে আসা মো. নূরে আলম বলেন, ঘরে তেল নেই। অফিস থেকে ফেরার সময় মহল্লার দোকান থেকে কিনে বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলেন, কিন্তু লক্ষ্মীবাজারের কোনো দোকানেই বোতলজাত সয়াবিন তেল পাননি। সকাল থেকে আশপাশের তিনটি বাজার ঘুরেও বোতলজাত তেল পাননি। পরে নয়াবাজারে এসেও একই অবস্থা। পাঁচটি বাজার ঘুরেও তেল পাননি।
জিনজিরা কাঁচাবাজারে তেল কিনতে আসা মো. ইসহাক বলেন, সব সময় চুনকুটিয়া বাজার থেকে কেনাকাটা করেন। সেখানে বোতলজাত তেল নেই। এলাকার মুদি দোকানেও তেল পাননি। এরপর গোলামবাজার, হিজলতলা কাঁচাবাজার ঘুরেও তেল না পেয়ে জিনজিরা বাজারে এসেছেন। তবুও বোতলজাত তেল পাচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে খোলা সয়াবিন লিটারে ২০০ টাকা দিয়ে কিনেছেন।
মুদি ব্যবসায়ী মো. সোহেল বলেন, চার মাস ধরে দেশের ছয় থেকে সাতটি কোম্পানি তাদের ডিলারের কাছে তেল সরবরাহ করছে না। রোজার আগে বাজারে সব শ্রেণির মানুষ কেনাকাটা করে। এ সময় কোম্পানিগুলো তেল দেওয়া বন্ধ করেছে। নতুন করে দাম বাড়াতেই কোম্পানিগুলো এমন করছে। সরকার দাম বাড়িয়ে দিলেই বাজারে তেলের অভাব থাকবে না। ডিলাররাও এমন কথা বলেছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, বিগত বছরে ৫ থেকে ৬টি কোম্পানি সয়াবিনের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়ার পর সাপ্লাই বন্ধ করে দেয়। সরকারিভাবে দাম বাড়ালেও তারা বাজারে পর্যাপ্ত তেলের সরবরাহ করে না। এবার রোজা ঘিরেও তারা এমন কারসাজি করছে। বাজার তদারকি সংস্থা তাদের ধরছে না। শাস্তির আওতায় আনছে না।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা হায়দার বলেন, সামগ্রিক বিষয় পর্যালোচনা করে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও বেশি ভোজ্যতেল বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। পবিত্র রমজান সামনে রেখেই বাড়তি চাহিদা বিবেচনায় তাদের সংগঠনে যুক্ত প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি সরবরাহ করছে। ভোজ্যতেলের সরবরাহের পরিমাণ বিবেচনায় সংকটের কোনো সুযোগ নেই। সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, সিটি গ্রুপ আগের চেয়ে বেশি তেল বাজারে সরবরাহ করছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান বলেন, বাজারব্যবস্থায় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের একটি অংশ এখনো সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। ভোজ্যতেলের সরবরাহে কিছু ব্যবসায়ী অসহযোগিতা করছে, যা বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে পারে। এ সংকটের কারণ খুঁজতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।